এপ্রিল ফুল আসলে কী ?

এপ্রিল ফুল আসলে কী ?

প্রথমেই কিছু দরকারি কথা জানা থাকা দরকার। অনেকেই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কেনো শুধু শুধু এমন প্রচলিত বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি? তাদের জানা প্রয়োজন, মিথ্যা দিয়ে কখনো সত্যকে বেগবান করা যায় না। ইতিহাসের যেটা সত্য আমরা সেটাকেই আমাদের ধর্মীয় মানসে লালন করবো। একটি অযাচিত আবেগী মিথ্যা দিয়ে কেনো আমরা কলঙ্কিত করবো আমাদের রক্ষিত ইতিহাসকে? স্পেনে মুসলমানদের পরাজয় এবং সেখান থেকে বিতাড়নের ইতিহাস অবশ্যই আমাদের জন্য বেদনার উপলক্ষ।
আমাদের সোনালি ইতিহাসে একটি জ্বলজ্বলে ক্ষত। গ্রানাডা, কর্ডোভা (কুরতুব; আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা পাশ্চাত্যের কর্ডোভার আরবি নাম আসলে কুরতুব। বিখ্যাত তাফসিরকারক ইমাম কুরতুবির জন্ম হয়েছিলো এখানে, আলহামরা, আন্দালুস- এসব নাম আমাদের মুসলিম মানসে চিরায়তভাবেই মিশে গেছে। আমাদের চোখের শার্শী বন্ধ করলে এখনো আমরা যেনো আন্দালুসের সেই সটান দাঁড়িয়ে থাকা মিনার চূঁড়াগুলো দেখতে পাই। দেখতে পাই গ্রানাডা থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের নারকীয় দৃশ্যাবলি। এগুলো আমাদের অনেক পুরনো বেদনার অনুষঙ্গ, আমাদের জাগরুক চেতনার অগ্নিশিখা। কিন্তু তাই বলে একটি মিথ্যা দিয়ে তো আমরা আমাদের সেই জাগরুক চেতনাকে কলঙ্কিত করতে পারি না। হোক আমাদের বেদনার ইতিহাস, হোক তা শোকের; একটি নির্জলা মিথ্যাকে কেনো আমরা আমাদের ধর্মীয় আবেগের অন্দরবাড়িতে জায়গা দেবো? সত্য ধর্মের জন্য সত্য ইতিহাস আমাদের জানতেই হবে।
যাই হোক, এবার আমরা দেখতে চাই যে, এপ্রিল ফুল জিনিসটি আসলে কী চিজ। প্রথমেই আমরা সাহায্য নিচ্ছি পৃথিবীর সবচে বৃহৎ দালিলিকগ্রন্থ এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার। এপ্রিল ফুল নিয়ে সেখানে লেখা আছে- April Fools’ Day, also called All Fools’ Day, in most countries the first day of April....
ব্রিটানিকা বলছে, ‘এপ্রিল ফুল দিবসকে অনেক দেশে ‘অল ফুলস ডে’ নামেও ডাকা হয়। এটি গ্রহণ করা হয়েছে মূলত এপ্রিলের প্রথম তারিখে হাস্য-কৌতুকের দিবস হিসেবে।... এটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। এ দিবসকে প্রাচীন রোমের হিলারিয়া উৎসবের মতো উদযাপন করা হতো মার্চের ২৫ তারিখে,...তবে নতুনভাবে দিবসটি পালন করা হয় সম্ভবত ফ্রান্সের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গৃহীত হওয়ার পর থেকে, যা পূর্ববর্তী নতুন বছর শুরুর দিন ২৫ মার্চ থেকে জানুয়ারি ১ লা তারিখে পরিবর্তন করা হয় ১৫৮২ সালে।’
এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, অনেক আগে থেকেই পহেলা এপ্রিল বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হতো। তবে কিভাবে যে এপ্রিল ফুলের সূচনা হয় তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। প্রাচীনকালে জনপ্রিয় উৎসবসমূহ পালিত হতো বসন্তকালীন বিষুব সময়ে (vernal equinox), অর্থাৎ যে সময়ে দিনরাত মোটামুটি সমান থাকে। সময়টি হলো ২১ মার্চ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ঋতু পরিবর্তনের প্রান্তিক সময় ২৫ মার্চ থেকে ২ রা এপ্রিল (অর্থাৎ শীতের শেষে বা বসন্তের শুরুতে) পুরাতন জুলিয়ান (Julian) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী গোটা ইউরোপে সপ্তাহব্যাপী উৎসব উদযাপন চলতো। আঠার শতকে এপ্রিল ফুল বর্তমান অবয়ব ধারন করার আগ পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনে সাধারণ মানুষদের ঐতিহ্যবাহী মেলা বসতো প্রতিবছরের পহেলা এপ্রিলে। স্কটল্যান্ডে এই দিনটিকে বলা হতো ‘কোকিল শিকারের দিন (hunting the gowk or cuckoo)’। এপ্রিল ফুল নতুনরূপে জন্মলাভের পর এর নামকরণ করা হয় এপ্রিল-কোকিল (April-gowks)।
ইউরোপে সম্ভবত এপ্রিল ফুলের বিস্তৃতি ঘটে প্রথমে ফরাসিদের মধ্যে। ফ্রান্সই হলো প্রথম দেশ যে দেশে সরকারিভাবে নবম চার্লস (Charles IX) ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ লা জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন । তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালিয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি (Pope Gregory XII) প্রবর্তিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার (যেটিকে আমরা বর্তমানে ভুল করে ইংলিশ ক্যালেন্ডার বলি) হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। এরই সাথে ১ লা এপ্রিলে বন্ধু-বান্ধবদের উপহার দেয়া নেয়ার প্রথাটি বদল হয়ে চলে যায় ১ জানুয়ারি বা নিউ ইয়ার উদযাপনের প্রাক্কালে। কারণ তখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউ ইয়ার পালিত হতো ১ লা এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই অর্থাৎ ১ লা এপ্রিলেই তাদের পুরোনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিপরীত ১ জানুয়ারির পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাঁকি দিতে ১ লা এপ্রিলে ভূয়া উপহার পাঠানোর কালচারটি চালু করে। এখান থেকেই মূলত চালু হয় ‘এপ্রিল ফুল ডে’ অর্থাৎ এপ্রিলের বোকা দিবস। কেননা সেসময় যারা নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে বিদায় দিয়েছিলো তারা বিদ্রুপ করে অন্যান্য যারা তখনো জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষগনণা করতো তাদেরকে বোকা বানাতে ১ লা এপ্রিলে নববর্ষের উপহার পাঠাতো। এতে প্রাচীনপন্থীরা বোকা বনে যেতো এবং নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারধারীরা উপহার পাঠিয়ে তাদেরকে পশ্চাদপদ বলে উপহাস করতো।
ডাচরা পহেলা এপ্রিল পালন করে অন্য কারণে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিলো তারা নিজেদেরকে গুইযেন (ডাচে Geuzen ও ফরাসিতে gueux বলা হয়, যার অর্থ ভিখারী) বলে পরিচয় দিতো। ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোটো শহর ডেন ব্রিয়েল (Den Briel) করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেষ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান দ্যা ডিউক অব অ্যালবা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। ‘ব্রিয়েল’ হলো ডাচ শব্দ, যার অর্থ কাঁচ। ১৯৭২ সালের ১ লা এপ্রিল স্মরণে ডাচরা বিদ্রুপ করে স্প্যানিশদের ‘অ্যালবা কাঁচ হারিয়েছে (Alba lost glasses)’ বলে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে থাকে। উল্লেখ্য, অ্যালবা ছিলো স্পেনের একটি শহরের নাম, যেখানে দ্যা ডিউক অব অ্যালবার সদর দপ্তর ছিলো।
এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর জোসেফ বসকিন (Joseph Boskin)। তিনি বলেছেন, এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (২৮৮-৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ) শাসনামলে। হাসি-ঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল বোকা গোপালভাঁড়েরা সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা মহোদয় বেশ পুলকিত হলেন। রাজা গোপালভাঁড়দের সর্দার কুগেলকে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যময় আইন জারি করে দিলো, প্রতিবছরের এইদিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। আর সে দিনটি ছিলো এপ্রিলের ১ লা তারিখ।
১৯৮৩ সালে বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত বসকিনের এই ব্যাখ্যাটি অনেক কাগজে নিবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। বসকিন মূলত আগের সব ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টিকেলটি ছাপানোর আগে এপি দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেছে তারা নিজেরাই এপ্রিল ফুলের বোকামির শিকার হচ্ছে না তো!
অন্যান্য দিবসের মত এই দিবসটির উৎপত্তি প্রাশ্চাত্যে শুরু হলেও এর বিস্তৃতি এখন দেশে দেশে। শুধুমাত্র বাংলাদেশে (বৃহৎ অর্থে, উপমহাদেশে) কিছু মুসলমানদের মধ্যে এপ্রিল ফুলের ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এই এপ্রিল ফুল বিষয়টি কিন্তু কেবল আমাদের উপমহাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যোগ হয়েছে, আরব বা অন্যান্য মুসলিম দেশে এপ্রিল ফুলের নাম নিয়ে কোনো ধরনের মর্সিয়া ক্রন্দন করা হয় না। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, আমাদের পূর্ববর্তী কোনো ইমাম, আকাবির, গ্রন্থপ্রণেতা কিন্তু স্পেনে এপ্রিল ফুল টাইপের কোনো ইতিহাস বর্ণনা করেননি। হ্যাঁ, গ্রানাডা চুক্তির পর তাদের ওপর নির্যাতনের অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় তবে সেগুলো নির্দিষ্ট করে এপ্রিলের ১ লা তারিখের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। বিগত ছয়শো বছরের কোনো আকাবিরই (ইসলামি স্কলার) এমন কোনো আলোচনা করে যাননি অথবা তারা এ ইতিহাস জানতেন না- এমন ভাবনা বোকারাও ভাববে না নিশ্চয়ই ।
প্রতিবছর ১ লা এপ্রিল আসলেই ফেসবুকে, ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা আর কিছু মানুষের মুখে শোনা যায়, এদিনে মুসলিমদের বোকা হওয়ার ইতিহাস, খ্রিস্টানদের অপরাধের ইতিহাস আর মুসলিমদের এদিন পালন না করার উপদেশ। বস্তুত আমরা কখনো ইতিহাস না জেনে, পড়াশোনা না করে কেবল অন্যের আবেগী কথায় কান দিয়ে এমন ভুল ইতিহাস পালন করছি। ধর্মকে পুঁজি করে এ ধরনের অপপ্রচার শুধুমাত্র আমাদের দীনতা এবং অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করে। আমাদেরকে ঈমানদার মুসলিম বা হামদর্দি মুসলিম করে না।
এপ্রিল ফুল নিয়ে আলোচনার শেষদিকে আমরা এ বিষয়েরই ভিন্ন একটি দিকে আলোকপাত করতে চাই। এ আলোচনার পর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এপ্রিল ফুলকে মুসলমানদের বেদনার দিবস বানালো কে? এটি একটি কঠিন প্রশ্ন। অন্তত আমাদের জন্য। কেননা আমরা এখনো জানতে পারিনি ঠিক কবে থেকে কোথায় প্রথম এই এপ্রিল ফুল বিষয়টি মুসলমানদের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে। কারাই বা এগুলো মুসলিম সংস্কৃতির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে- সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আমরা কিছু সম্ভাবনার ভিত্তিতে কয়েকটি কারণ নির্ণয় করতে পারি, যেগুলো তথ্যনির্ভর না হলেও সত্যের অনেক কাছাকাছি হবে বলেই আশা করি।
হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
আলেম, সাংবাদিক, সাবেক সহযোগী সম্পাদক, সপ্তাহিক লিখনী

No comments:

Post a Comment