কালেমার মর্মকথা : ব্যক্তি জীবনে কালেমার গুরুত্ব ও মর্যাদা

           কালেমার মর্মকথা : ব্যক্তি জীবনে কালেমার গুরুত্ব ও মর্যাদা


ব্যক্তি জীবনে কালিমার গুরুত্ব ও মর্যাদা 
এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণী যা মুসলমানগণ তাদের আজান, ইকামাত, বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করে থাকে। এটি এমন এক কালেমা যার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আসমান-জমিন, সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত মাখলুকাত। আর এর প্রচারের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য রাসূল এবং নাজিল করেছেন আসমানি কিতাবসমূহ, প্রণয়ন করেছেন অসংখ্য বিধান। প্রতিষ্ঠিত করেছেন তুলাদন্ড (মিযান) এবং ব্যবস্থা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের, তৈরি করেছেন জান্নাত এবং জাহান্নাম।
এই কালেমাকে স্বীকার করা এবং অস্বীকার করার মাধ্যমে মানব সম্প্রদায় ঈমানদার এবং কাফির এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। অতএব সৃষ্টি জগতে মানুষের কর্ম, কর্মের ফলাফল, পুরস্কার অথবা শাস্তি সব কিছুরই উৎস হচ্ছে এই কালেমা। এরই জন্য উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টিকুলের, এ সত্যের ভিত্তিতেই পরকালীন জিজ্ঞাসাবাদ এবং এর ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হবে সওয়াব ও শাস্তি। এই কালেমার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলমানদের কেবলা এবং এ হলো মুসলমানদের জাতি সত্তার ভিত্তি-প্রস্তর এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য খাপ থেকে খোলা হয়েছে জিহাদের তরবারি।
বান্দার উপর এটাই হচ্ছে আল্লাহর অধিকার, এটাই ইসলামের মূল বক্তব্য ও শান্তির আবাসের (জান্নাতের) চাবিকাঠি এবং পূর্বাপর সকলই জিজ্ঞাসিত হবে এই কালেমা সম্পর্কে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কার ইবাদত করেছ? নবিদের ডাকে কতটুকু সাড়া দিয়েছ? এই দুই প্রশ্নের উত্তর দেয়া ব্যতীত কোন ব্যক্তি তার দুটো পা সামান্যতম নাড়াতে পারবে না। আর প্রথম প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ -কে ভালো ভাবে জেনে-বুঝে এর স্বীকৃতি দান করা এবং এর দাবি অনুযায়ী কাজ করা। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সঠিক হবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসাবে মেনে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে। আর এ কালেমাই হচ্ছে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। এ হচ্ছে আল্লাহ ভীতির কালেমা ও মজবুত হাতল। এবং এ কালেমাই নবি ইব্রাহীম আলাইহিস্সালাম ‘‘অক্ষয় বাণীরূপে রেখে গেলেন তাঁর পরবর্তীতে তাঁর সন্তানদের জন্য, যেন তারা ফিরে আসে এ পথে’’।
এই সেই কালেমা যার সাক্ষ্য আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নিজেই নিজের জন্য দিয়েছেন, আরো দিয়েছেন ফিরিশতাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ। আল্লাহ তাআলা বলেন ,
شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, নিশ্চয় তিনি ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই এবং ফিরেশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮ )
এ কালেমাই ইখলাছের বা সত্যনিষ্ঠার বাণী। এটাই সত্যের সাক্ষ্য ও তার দাওয়াত এবং শিরক এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার বাণী এবং এ জন্যই সমস্ত জগতের সৃষ্টি।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরানে বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধু আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা আয্যারিয়াত-৫৬)
এই কালেমা প্রচারের জন্য আল্লাহ সমস্ত রাসূল এবং আসমানি কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন ,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدُونِ
‘‘আমরা তোমার পূর্বে যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাঁর নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর।’’ (সূরা আল্ আম্বিয়া, আয়াত ২৫)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরানে আরো বলেন ,
يُنَزِّلُ الْمَلآئِكَةَ بِالْرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَن يَشَاء مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنذِرُواْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَاْ فَاتَّقُونِ
‘‘তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে রুহ (অহি) সহ ফিরিশতা প্রেরণ করেন এই বলে যে, তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমাকেই ভয় কর।’’ (সূরা আন্নাহাল, আয়াত -২)
ইবনে উইয়াইনা বলেন, ‘বান্দার উপর আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রধান এবং বড় নেয়ামত হলো তিনি তাদেরকে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ" তাঁর এই একাত্ববাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ার পিপাসা কাতর তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের নিকট ঠান্ডা পানির যে মূল্য আখেরাতে জান্নাতবাসীদের জন্য এ কালেমা তদ্রুপ।’’ এবং যে ব্যক্তি এ কালেমার স্বীকৃতি দান করল সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করল। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করল সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর স্বীকৃতি দান করল এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করল তার ধন-সম্পদ ও জীবন নিরাপদ হল এবং তার কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর উপর বর্তাল।’ (সহিহ মুসলিম)
একজন কাফেরকে ইসলামের প্রতি আহবানের জন্য প্রথম এই কালেমার স্বীকৃতি চাওয়া হয়। নবি সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুআজ (রা.)-কে ইয়ামানে ইসলামের দাওয়াতের জন্য পাঠান তখন তাঁকে বলেন, ‘তুমি আহলে কিতাবের নিকট যাচ্ছ, অতএব সর্ব প্রথম তাদেরকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সাক্ষ্য দান করার জন্য আহবান করবে। (সহিহ মুসলিম )
প্রিয় পাঠকগণ! এবার চিন্তা করুন, দ্বীনের দৃষ্টিতে এ কালেমার স্থান কোন পর্যায়ে এবং এর গুরুত্ব কতখানি। এজন্যই বান্দার প্রথম কাজ হলো এ কালেমার স্বীকৃতি দান করা; কেননা এ হলো সমস্ত কর্মের মূল ভিত্তি।
মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম বিন আলী আহমদ 

No comments:

Post a Comment