এপ্রিল ফুল : ইতিহাসের নতুন ইতিহাস
এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, খ্রিস্টানদের এই নির্যাতনের আওতায় কেবল মুসলমানরাই ছিলো না বরং গ্রানাডার অধিবাসী প্রায় তিন লাখ ইহুদিকেও এই একই ভাগ্যবরণ করতে হয়। উপরন্তু ইহুদিদের ওপর খ্রিস্টানরা মুসলমানদের চেয়ে বেশি নির্যাতন চালায় এবং ১৪৯২ সালের ৩১ মার্চ [এই তারিখটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন] রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ড ইহুদিদের দমনে ‘আল-হামরা ডিক্রি’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
সেখানে ইহুদিদের দুটি প্রধানশর্ত দেয়া হয়। এক. যদি স্পেনে থাকতে চাও তবে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করতে হবে; দুই. অন্যথায় এ দেশ থেকে চলে যেতে হবে। ষড়যন্ত্রপ্রিয় এবং দাঙ্গাপ্রিয় ইহুদিদেরকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে স্পেন থেকে তাড়ানো হয়।
১৪৯২ সালের মার্চে যদিও স্পেনের ইহুদিদের ৩ মাসের সময় দিয়ে আল-হামরা ডিক্রি জারি করা হয় কিন্তু এ ডিক্রির আওতায় মুসলমানরা ছিলো না। কেননা ২ রা জানুয়ারি ১৪৯২ সালে যে ‘ট্রিটি অব গ্রানাডা’ স্বাক্ষরিত হয় সেখানে মুসলমানদের সঙ্গে এ ধরনের কোনো আচরণ করা হবে না বলে শর্তারোপ করা ছিলো। তাই খ্রিস্টান শাসকরা কার্যত তখনো মুসলমানদের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারেনি।কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকেই ক্রমান্বয়ে খ্রিস্টানরা গ্রানাডাচুক্তির শর্তগুলো ভাঙতে শুরু করে এবং ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে তারা তাদের স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ইহুদিদের মতো মুসলমানদেরকেও একই শর্ত দিয়ে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়; হয় তোমাদের খ্রিস্টান হতে হবে নয়তো ছাড়তে হবে স্পেন।
এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত বেদনাবহ এবং করুণ। প্রাণের ভয়ে হাজার হাজার মুসলমান খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে, নিজেদের মুসলিম পরিচয় বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করে ক্যাথলিকিজম। যাদের সামর্থ্য ছিলো তারা মাতৃভূমি ছেড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। আর এভাবেই একসময় সমগ্র স্পেন হয়ে পড়ে মুসলিমশূন্য এক খ্রিস্টান দেশ। অনেকেই মনে করতে পারেন যে, এই দেশত্যাগ এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার সময়ে হয়তো এপ্রিল ফুল ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আল-মাকারি বা অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ মুসলমানদের স্পেনত্যাগের যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন সেখানে এমন কোনো তথ্য পরিবেশিত হয়নি।নির্ভরযোগ্য তথ্যের ওয়েবসাইট উইকিপিডিয়াতে মুসলমানদের স্পেনত্যাগের বিষয়টি অত্যন্ত নিরাবেগভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে- সূত্র:http://en.wikipedia.org/wiki/Morisco#Genetic_legacy_of_Moriscos_in_Spain
এ বিষয়টি নিয়ে ২০০৯ সালের ৪ সেপ্টেম্ব বিবিসি Muslim Spain (711-1492) নামে একটি ডকুমেন্টারি আর্টিকেল প্রকাশ করে। আর্টিকেলটির একদম শেষদিকে বলা হয়- The Muslims finally lost all power in Spain in 1492. By 1502 the Christian rulers issued an order requiring all Muslims to convert to Christianity, and when this didn't work, they imposed brutal restrictions on the remaining Spanish Muslims. “মুসলিমরা চূড়ান্তভাবে তাদের ক্ষমতা হারায় ১৪৯২ সালে। ১৫০২ সালে খ্রিস্টান সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সমস্ত মুসলমানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আদেশ দেয়; সবাই সেটি মান্য না করায় তাদের ওপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন।” সূত্র :http://www.bbc.co.uk/religion/religions/islam/history/spain_1.shtml
আমার এতোক্ষণের আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছি যে, স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাসে এপ্রিল ফুল বলতে কিছু নেই এবং পহেলা এপ্রিলেরও কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। অধুনা আমরা যে ‘এপ্রিল ফুল’ বলে বেদনাহত হই সেটাও নিতান্ত আবেগী অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এপ্রিল ফুল বিষয়টি এলো কোথা থেকে ? কেনোই বা এটি আমাদের সংস্কৃতিতে সংযোজিত হলো? সে বিষয়টিও অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক।
হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
আলেম, সাংবাদিক, সাবেক সহযোগী সম্পাদক, সপ্তাহিক লিখনী
আলেম, সাংবাদিক, সাবেক সহযোগী সম্পাদক, সপ্তাহিক লিখনী
No comments:
Post a Comment