শীতের আমেজ উপভোগে কিছু পরিকল্পনা



শীতকাল মানেই মনে হয় চারদিকে ঘন কুয়াশায় আবৃত পরিবেশ। শহরে ঘুম থেকে উঠেই ধোঁয়া উঠা চা বা কফির কাপে হাত বাড়ানো আর গ্রামে রান্না ঘরে মায়ের চারপাশে বসে সব ভাই-বোনেরা গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার প্রতিযোগিতা ।শীত একটা চমৎকার মৌসুম আর আমাদের দেশে খুবই অল্প সময়ের জন্য আসে। কিন্তু শীতের দিনে বদলে যায় আমাদের অনেকের লাইফ স্টাইল। চলা ফিরায় সব কিছুতেই যেন এক ধরণের জড়তা কাজ করে। অলসতার ছাপ পরে সব কাজেই। যার ফলে দিনগুলি কেটে যায় খিটখিটে মেজাজ গোমরা মুখ নিয়ে। কিন্তু এই গোমরা মুখ আর খিটখিটে মেজাজ নিয়ে আর না আসুন আজই এই অলসতাগুলি কাটিয়ে শীতের আমেজটাকে উপভোগ করি আর এজন্য চাই উদ্দীপনাময় কিছু পরিকল্পনা ।

ঘুম থেকে উঠেই রুটিন মতো কাজে লেগে যাবেন না। বিছানায় শুয়েই কিছুক্ষণ স্ট্রেচিং করুন। যোগ ব্যায়াম করতে পারেন। সম্ভব হলে ঘুম থেকে উঠে কুসুম গরম পানিতে গোসল করে নিতে পারেন। এতে মাথা থেকে ঘুমের রেশ কেটে যাবে জলদি। দেখবেন শরীর অনেক ফুরফুরে লাগছে। তখন খুব বেশি শীতের জামা পড়ার দরকার হবে না ।এই সময় খুব বেশি জামা কাপড় পরে ঘেমে গিয়ে বুকে ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে ফেলতে পারেন। ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটাই পরুন ।আপনার ভালো লাগে এমন কোন কাজ দিয়ে শুরু করুন দৈনন্দিন কাজ ।

স্বাস্থ্যের যত্ন : এই সময়ে স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ যত্ন নিতে হয় । এই সময় সর্দি, কাশি, জ্বর, শরীর মেজমেজে ভাব লেগেই থাকে। এই শীতে প্রয়োজন নিজের শরীরের ভেতর থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। শীত হচ্ছে তাজা শাক-সবজির মওসুম। অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে সবজির দামও একটু কম থাকে। বেশি বেশি তাজা শাক-সবজি খাবেন। তাতে আপনার শরীর বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। খেতে হবে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার।
আসুন, জেনে নেই এমন কিছু খাবার যা এই শীতে আপনাকে উষ্ণতা দিবে এবং সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ:

মধু: ঘুম থেকে উঠে হাল্কা ব্যায়াম সেরে খালি পেটে খেতে পারেন এক গ্লাস হাল্কা গরম পানিতে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে। শীতে সব চাইতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান হচ্ছে মধু। অ্যান্টি অক্সিডেনট ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান সমূহ শীতের যাবতীয় অসুখ বিসুখ দ্রুত সারিয়ে তোলে। মধু রোগ প্রতিরোধক এবং সাধারণ ফ্লু উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে। সাথে টুকরো লেবুর রস মিশাতে পারে। তবে গ্যাস্টিকের সমস্যা থাকলে লেবু না নেয়াটাই ভালো। এতে গ্যাস্টিক বেড়ে যেতে পারে। আর এক বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মধু না খাওয়ানই ভালো ।
রসুন: জ্বর ও ঠাণ্ডা থেকে দূরে থাকতে কিংবা দ্রুত সেরে উঠতে রসুন এক মহৌষধ। রসুন শরীরে নানা এনজাইমের মাত্রা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা রক্ত ভালো রাখে এবং শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তবে কাঁচা রসুন সবচাইতে উপকারী। কাঁচা চিবিয়ে খেতে না পারলে সালাদের সাথে খান।
গাজর: ভিটামিন ‘এ’ ও বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ গাজর ঠাণ্ডা ও নানান রকম সংক্রামক রোগপ্রতিরোধে সাহায্য করে। এ ছাড়া শীতকালের খুব সাধারণ কিছু সংক্রামক রোগ থেকেও রক্ষা করে গাজর। অবশ্যই গাজর কাঁচা খাওয়াই সবচাইতে ভালো। দৈনিক অন্তত একটি গাজর খান ।
মিষ্টি আলু: শীতকালের এই সবজিটিরও রয়েছে শীত দূর করার ক্ষমতা। ফাইবার, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন সমৃদ্ধ এই মিষ্টি আলুকে বলা হয় সুপারফুড যার রয়েছে দেহকে নানা ধরণের রোগ থেকে মুক্ত রাখার পাশাপাশি শীত তাড়ানোর বিশেষ ক্ষমতা।
ওটমিল: শীতকালে উষ্ণতা পাওয়ার সবচাইতে কার্যকরী খাবার হচ্ছে ওটমিল। এটি হোল গ্রেইন, সুতরাং এতে আপনার দেহে পৌঁছাবে ফাইবার এবং উদ্ভিজ্জ প্রোটিন যা দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। এছাড়াও ওটমিলে রয়েছে বেটা-গ্লুকেন নামক স্টার্চ যা আমাদের দেহের খারাপ কলেস্টোরল কমাতে সহায়তা করে ।
সুপ: শীতকালে সুপ পানের ফলে উষ্ণতার পাশাপাশি স্বাদ ও স্বাস্থ্য দুটোর প্রতিই বেশ ভালো নজর দেয়া যায়। বিশেষ করে তা যদি কুমড়োর সুপ হয়ে থাকে। শরীর গরম রাখতে শীতের সন্ধ্যায় খেতে পারেন সুপ জাতীয় খাবার।
আদা: আদা আমাদের দেহের রক্তের সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। দিনে দু/তিন বার খেতে পারেন আদা চা। আদা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে ।

ত্বকের যত্ন: শীতে ত্বক হয়ে উঠে শুষ্ক রুক্ষ তাই এই সময় চাই একটু বাড়তি যত্ন । ঘুম থেকে উঠেই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ না ধুয়ে হাল্কা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন সাবানের পরিবর্তে কোন ফেস ওয়াস দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন এবং হাল্কা হাতে কোন ময়েশ্চারাইং ক্রিম মেখে নিন এই সময় গ্লিসারিন যুক্ত সাবান ব্যবহার করুন। গোসলের পানিতে কয়েক ফোটা তেল মিশিয়ে নিতে পারেন এতে ত্বক কমল থাকবে। সারাদিনে এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠোঁটে ভেসলিন লাগাতে পারেন গ্লিসারিন এবং পানি মিশিয়ে হাতে পায়ে মেখে নিতে পারেন তাতে হাত পা কোমল থাকবে ।শীতের এই সময় খুশকি বারে তাই রাতে নারিকেল তেল গরম করে চুলের গোঁড়ায় লাগিয়ে পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলুন,শীত বা গ্রীষ্ম সব সময় ভিটামিন সি ও ই ত্বক ও চুলের জন্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ।


শিশুদের যত্ন: শীতের সময়টাই বাচ্চাদের ত্বকের যত্নের ব্যাপারে হতে হবে সতর্ক ও মনোযোগী। গোসলের জন্য কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। বাচ্চার ত্বকের যত্নে অলিভ অয়েল ও ভিটামিন ই সমৃদ্ধ তেল ব্যবহার করতে পারেন। শীত থেকে শিশুকে বাঁচাতে সকাল-বিকাল কান ঢাকা টুপি ও হালকা শীতের কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। শিশুরা যেন খালি পায়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে মোজা পরিয়ে রাখুন।

মানুষের উপকারে আসুন: এই সময়টা একটা সুযোগ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আপনার প্রতিবেশী কিংবা গরীব আত্মীয় স্বজনদের পাশে দাঁড়ান, তাদের শীতবস্ত্র, কম্বল কিনে দিতে পারেন, নিজেদের ফেলে রাখা শীতের কাপর গুলিও গরীব মানুষদের দিয়ে দিতে পারেন ।

আত্মীয়তা সতেজ করা: পিঠা-পুলির দেশ বাংলাদেশ। শীতকে উপভোগ করার আরেকটা মজার দিক হল পিঠা-পুলির আয়োজন। এই সুযোগ আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে তাদের সাথে নির্জীব সম্পর্ক তাকে সজীব করিয়ে নিতে পারেন। সবাই মিলে একসাথে পিঠা-পুলি খাওয়ার মজাই আলাদা। যারা প্রবাসে থাকেন তারা করতে পারেন ওয়ান ডিস পার্টি। সবাই এক এক রকমের পিঠা বানিয়ে একসাথে বসে আড্ডা জমাতে পারেন ।

ঘুরতে যাওয়া: শীতকাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। শীতের এই সময়টা ঘরে বসে না থেকে নিজ পরিবার ও কাছের বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন দূরে কোঁথাও ।অনেকটা পিকনিকের মতো করে। এই সুযোগে দেখা হবে অনেক প্রকৃতির অনেক সৌন্দর্য ।

শীতের দিনের কিছু সতর্কতা: শীতের সন্ধ্যাগুলো গরমের দিনের মত লম্বা আর ক্লান্তিকর বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামে না, বরং ঝুপ করেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।

জেনে নিন কিছু টিপস, যা কাজে আসবে শীতের সন্ধ্যায়:
১) ঘড়ির কাঁটা ৫ টা পার হতেই ঘরের জানালগুলো বন্ধ করে দিন। প্রয়োজন হলে ৮টার পর আবার খুলুন। তবে ৫ টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত বন্ধ রাখলে ঘরে মশার উপদ্রব একদমই হবে না। সারাটা রাত থাকবেন শান্তিতে।
২) শীতের সময় জানালা ও দরজায় মোটা কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করুন তাতে বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকবে কম ।
৩) শীতের বিকেলে একটু ভাজাভুজি খেতে সবারই ইচ্ছা করে, তাই না? এই ইচ্ছাটা হচ্ছে বলেই দুম করে এটা ওটা ভাজা পোড়া খেয়ে ফেলবেন না। স্বাস্থ্যের কথাটাও একটু ভাবতে হবে, নাকি? ভাজার বদলে খাবারটা ওভেনে বেক করে ফেলুন একটু তেল মাখিয়ে। তা সে সমুচা, সিঙ্গারা যাই হোক না কেন।
৪) চা কিংবা কফি খুঁজছেন শরীর গরম করতে? পান করুন এক বাটি সুপ। শরীরে উষ্ণতা যোগাবে, সাথে দেহে যোগাবে পুষ্টি।
৫) শীতের বিকেল ও সন্ধ্যাগুলো হয় ধুলোয় ভরা। তাই অফিস এসে বাড়ি ফেরার পথে নাকমুখ ভালো করে ঢেকে রাখুন। দেখবেন গোটা শীতকাল জুড়েই অসুখ কম করবে।
৬) শীত লাগুক বা না লাগুক, সন্ধ্যা হতেই শীতের কাপড় পরে নিন। এতেও অসুখ বিসুখ কম হবে ইনশাআল্লাহ।
৭) মনে করে দিনে অন্তত এক ঘণ্টা উলের সোয়েটারকে রোদে দিয়ে নেবেন। এতে সোয়েটার থাকবে জীবাণুমুক্ত।
৮) বাড়ি মশা মুক্ত রাখতে সন্ধ্যা বেলায় ধূপ দিতে পারেন ঘরে।
৯) শীতের সন্ধ্যায় পান করুন এক কাপ রঙ চা। সাথে যোগ করুন মধু, আদা ও দারুচিনি। আল্লাহ চাহে তো অসুখ থেকে থাকতে পারবেন অনেক দূরে। ঘুম তাড়াতেও খুব কাজে আসবে।
১০) শীতের সময় ধুলোবালির প্রকোপ বেড়ে যায় অনেক খানি। এ সময় ঘরটা ছিমছাম ভাবে সাজান। ঘরের অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সরিয়ে দিন।
১১) শীতের সময়টায় কার্পেটের ব্যবহার প্রায় সব বাসায়ই কিন্তু এটা মনে রাখা জরুরি যে, কার্পেটে ধুলোবালি আটকায় প্রচুর। শুধু তা-ই নয়, বাড়তে পারে অ্যালার্জিও। তাই কার্পেট পরিষ্কার করতে হবে নিয়মিত।

পরিশেষে কথা হল, শীতের অলসতা কাটিয়ে আমাদেরকে যথাসময়ে সঠিকভাবে ওযু-গোসল করে সালাত আদায় করতে হবে। সেই সাথে জেনে নিতে হবে শীত কালীন গুরুত্বপূর্ণ মাসয়েলগুলো। যেমন, তায়াম্মুম, মোজার উপর মাসেহ করা, গোসল ইত্যাদি। এগুলো সম্পর্কে আমাদের শিশুদেরকে জ্ঞান দেয়ার পাশাপাশি তারা যেন নিজেরা এগুলো বাস্তবায়ন করে সেজন্য তাদেরকে সাহায্য করতে হবে।
সব মিলিয়ে আমাদের এই শীত মৌসুম কাটুক কিছুটা ভিন্ন আমেজে..হয়ে উঠুক আরও উপভোগ্য।

No comments:

Post a Comment